গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে গ্রীষ্মের গরম ও হিটওয়েভের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসাবে 2018 থেকে 2022 সালের মধ্যে বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রার 1986 থেকে 2005 সালের বেজলাইন এর চেয়ে গড়ে 0.9 ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। যা গ্লোবাল average 0.2 ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেশি। 2024 সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে টানা ২৪ দিন হিটওয়েভ চলেছিল যা বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি রেকর্ড। যার কারণে গত কয়েক বছরে দেশে বেড়েছে এসির ডিমান্ড। এক সময় একটি লাক্সারি হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে চিন্তা করা হলেও এসি এখন প্রয়োজনীয় একটি হোম অ্যাপ্লায়েন্স হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশে বছরে সাড়ে ছয় লক্ষ এসে বিক্রি হচ্ছে, আর এসির মার্কেট ছাড়িয়েছে 6 হাজার কোটি টাকা। প্রায় ২০টির কাছাকাছি লোকাল ও ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড এই মার্কেট সার্ভ হয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে দেশীয় এলেক্ট্রনিকস জাভান্ট ওয়ালটনের তথ্যসূত্রে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের এপির বাজারে লিডিং পজিশনে আছে। কিন্তু কিভাবে দেশীয় ব্র্যান্ড ওয়ালটন শীর্ষে উঠে এসেছে?
বাংলাদেশের হোম অ্যাপ্লায়েন্সে সেগমেন্টের বেশিভাগ পণ্যই একসময় আমদানি নির্ভর ছিল। 90 দশকের শেষদিকে ওয়ালটন এবং একে একে বেশকিছু লোকাল প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য ম্যানুফ্যাকচারিং এর কার্যক্রম শুরু করে। প্রথমদিকে এসব প্রতিষ্ঠান রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজ আর টিভি ও মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং শুরু করে। লোকাল প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত লোকালি ভ্যালু এড করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্ট আমদানি করে অ্যাসেম্বল করতো। এতে করে এ প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্টারন্যাশনাল ব্রান্ডের তুলনায় কম প্রাইসে প্রডাক্ট অফার পারছিল। যার কারণে কনজিউমাররাও লোকাল ব্র্যান্ডের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। 2014-2015 সালের দিকে চাইনিজ মোবাইল ব্র্যান্ডগুলোর মোবাইল বাড়তে শুরু করলে লোকাল ব্র্যান্ডগুলো রেফ্রিজারেটর এবং টিভির মার্কেটকে টার্গেট করে এগিয়ে যায়। যার ধারাবাহিকতায় চাহিদার প্রায় 97% দেশেই ম্যানুফ্যাকচার করা হয়। যেখানে ওয়ালটন রেফ্রিজারেটর একাই হোল্ড করে মার্কেটের 75%. একইভাবে টেলিভিশন মার্কেটেও লোকাল ব্র্যান্ডেগুলো ডমিনেটে করে যেখানে ওয়ালটনের মার্কেট সর্বোচ্চ 30% শেয়ার দখল আছে।
80-90 দশকে টেলিভিশন ও রেফ্রিজারেটর লাক্সারি হোম এপ্লায়েন্স হলেও 2000 সালের পর থেকে সারা দেশে এ দুটি পণ্য বাসার নিত্যপ্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক্স হয়ে উঠেছে। আজ থেকে এক দশক আগেও এসিকে লাক্সারি ইলেকট্রনিক্স হিসেবে গণ্য করা হতো। 2020 সালে যেখানে দেশে এসির তিন লক্ষ ইউনিট বিক্রি হয়েছিল, সেখানে 2023 সাল নাগাদ বিক্রি বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে 6 লাখ ইউনিট। ফলে এসির মার্কেট দাঁড়িয়েছে 6000 কোটি টাকা। 2004 সালে দেশে এসির ম্যানুফ্যাকচারিং শুরু হয়। কিন্তু তখন মাত্র 30 হাজার এসি বিক্রি হতো। 2007 সালে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে নিজস্ব ম্যানুফ্যাকচারিং এর মাধ্যমে রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজের পাশাপাশি এয়ারকন্ডিশনার ম্যানুফ্যাকচার করতে শুরু করে।
2011 সালে প্রথম মেইড ইন বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে এসি রপ্তানি করতে শুরু করে। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ওয়ালটন 2007 সালে নিজস্ব দক্ষ রিসার্চ ও ইনোভেশন টিমের প্রচেষ্টায় রেসিডেন্সিয়াল এসির পাশাপাশি কমার্শিয়াল এসি উৎপাদন শুরু করে। এছাড়া 2020 সালে বাংলাদেশের প্রথম এবং বিশ্বের নবম দেশ হিসেবে বিআরএফ ম্যানুফ্যাকচারিং শুরু করে কোম্পানিটি। বর্তমানে বাংলাদেশের এসি মার্কেটের পঞ্চাশ শতাংশের বেশি দখল করে আছে চাইনিজ ব্র্যান্ড গুলো। তবে এই শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে একমাত্র দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে ওয়ালটন, যা প্রশংসার দাবিদার। ওয়ালটন, গ্রিস, মিডিয়া ও হায়ার এই চারটি ব্র্যান্ড ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশীয় ব্র্যান্ড ও স্যামসাং, এলজিসহ প্রায় 40টির মত ইন্টারন্যাশনাল ব্রান্ড বাংলাদেশের এসির চাহিদা পূরণ করছে। এর মধ্যে কিছু ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড তাদের লোকাল পার্টনারদের সাথে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে লোকালি এসির এসেম্বলিং অথবা সরাসরি মানুফাকচারিং করছে। টিবিএস এর তথ্যসূত্রে 2023-2027 সাল পর্যন্ত দেশের এসির মার্কেট গড়ে ২৫% হারে বাড়তে থাকবে। যা লোকাল ব্র্যান্ডগুলোর আরো বেশি মার্কেট দখল করার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
2000 সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল এসি ইমপোর্ট করা হতো। সেসময় দেশে মূলত জেনারেল, career, স্যামসাং, এলজি এসব এসি বেশি ব্যবহৃত হতো। এছাড়া সেই সময় এসিকে লাক্সারি পণ্য হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। মূলত এ কারণে এবং ইমপোর্ট নির্ভর হওয়ার কারণে মূলত উচ্চবিত্তদের মধ্যেই এসির ব্যবহার সীমিত ছিল। 2000 সালের পর দেশে প্রথম চাইনিজ ব্র্যান্ডে লোকালি এসি অ্যাসেম্বল করতে শুরু করলে এসির দাম কিছুটা কমতে থাকে। কিন্তু আজ থেকে অর্ধ দশেক পূর্বে 2008 সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র 630 ডলার। সে সময় দেশের বেশিরভাগ কনজিউমারদের জন্য এসির মতো লাক্সারি পণ্য কেনা সম্ভব ছিল না। এদিকে 2015 সাল নাগাদ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় 2008 সালের তুলনায় দ্বিগুণ এরও কাছাকাছি উঠে আসে। আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা।
এদিকে শুরু থেকেই সম্পূর্ণভাবে ম্যানুফ্যাকচারিং এ ফোকাসের মাধ্যমে ওয়ালটনও নিজেদের ম্যানুফ্যাকচারিং ক্যাপাসিটি বাড়াতে থাকে। একটি এসির রেজিন ব্যতীত আর সকল যন্ত্রাংশের কাঁচামালই ওয়ালটন দেশে ম্যানুফ্যাকচার করে থাকে। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডগুলো এসির ছোট ছোট যন্ত্রাংশ দেশেই প্রস্তুত করলেও বেশিরভাগ কম্পোনেন্টই বিদেশ থেকে আমদানি করে তারপর অ্যাসেম্বলি করতো। যার কারণে ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডগুলোর তুলনায় affordable price এ সরবরাহ করতে পারছিল ওয়ালট।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন গুলো সাধারণত গ্লোবাল কনজিউমারদের কথা মাথায় রেখেই নিজে প্রোডাক্ট ডিজাইন করে থাকে। ফলে বাংলাদেশের মানুষদের জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় ফিচার থাকে অথবা প্রয়োজনীয় অনেক ফিচারই থাকে না। সেসব ফিচারের কারণে প্রোডাক্ট এর দামও বেশি হয়ে থাকে অথচ দেখা যায় কাস্টমার সেসব ফিচার ব্যবহারই করছে না। 2019 সালের প্রথম কোম্পানিটি নিজস্ব ডিজাইনের এসি রিলিজ করে। যেদিকে কিছু সমস্যা ও অসুবিধা দেখতে পেয়ে ওয়ালটন এসির জন্য আলাদা ইনোভেশন টিম তৈরি করে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ট্যালেন্টেডদের নিয়ে। যারা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এসির বিভিন্ন সুবিধা ও অসুবিধা পর্যালোচনা করে কিভাবে বাংলাদেশের কাস্টমারদের জন্য বেটার কোয়ালিট ও ফিচার সম্পন্ন এসি তৈরি করা যায় সেটা নিয়ে রিসার্চ করতে থাকে।
বর্তমানে এসির রিসার্চ ও ইনোভেশন টিমেই আছে 104 জনেরও বেশি রিসার্চার। এই টিমের সমন্বয়ে ওয়ালটন দেশের সিক্স স্টার এসি প্রোভাইড করতে শুরু করেছে, যা মার্কেটে অন্যান্য যে কোন ব্র্যান্ডের এসির চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। ওয়ালটন দেশীও কাস্টমারদের ইউজিং প্যাটার্ন এবং Preference এর কথা চিন্তা করে তাদের ফিচার সিলেক্ট ও ডিজাইন করে থাকে। ওয়ালটনই প্রথমবারের মতো বাংলা ও ইংরেজী দুই ভাষাতেই ভয়েস কন্ট্রোল এসি বাজারে এনেছে। এর পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর নেগেটিভ ইম্প্যাক্টকে অ্যাড্রেস করতে প্রতিষ্ঠানটি r32 রেফ্রিজারেট ব্যবহার করছে। এছাড়াও কোম্পানিটির সম্প্রতি সোলার হাইব্রিড এসিও লঞ্চ করেছে যা কাস্টমারের বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয়ের পাশাপাশি পরিবেশের জন্য sustainable.
ওয়ালটন বরাবরই আন্তর্জাতিক মানের পণ্য বাংলাদেশেই ম্যানুফ্যাকচার করার প্রতি জোর দিয়ে এসেছে। যার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমানের এসিতে ডিজিটাল ডিসপ্লেও ব্যবহার হচ্ছে। বাজারের অন্যান্য ব্র্যান্ডের তুলনায় ওয়ালটনের এসিতে ফিচার বেশি হলেও প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য ব্র্যান্ডের তুলনায় কম্পিটিটিভ প্রাইসে পণ্য অফার করছে। ইন ফ্যাট ওয়ালটন অন্যান্য ব্র্যান্ডের তুলনায় affordable প্রাইজে নিজের পণ্য বাজারে এনেছে। ফলে অন্যান্য ব্র্যান্ডগুলো তাদের অফারিং এর দামকমাতে বাধ্য হয়েছে। Affordable price point ও মানস মানসম্পন্ন পণ্য তৈরির পাশাপাশি ওয়ালটন ব্র্যান্ড বিল্ডিং এর দিকেও ফোকাস করেছে। ব্র্যান্ ভ্যালু এবং মানসম্পন্ন সেবার কারণে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো ইউজারদের preference পেয়ে এসেছে। এদিকে ওয়ালটন ততোদিনে রেফ্রিজারেটর মার্কেটে পণ্যের কোয়ালিটি ও সার্ভিস নিয়ে কাস্টমারদের বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়ে উঠেছে।
এসির ক্ষেত্রেও ওয়ালটন সর্বপ্রথম একবছরের রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি দিতে শুরু করে। এসি বা যেকোন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ হলো কাস্টমারদের after sell service প্রোভাইড করা। ওয়ালটন যেহেতু সবার আগেই দেশেই সম্পূর্ণভাবে এসির ম্যানুফ্যাকচারিং শুরু করেছে তাই কোম্পানিটি এসির যেকোনো সমস্যায় কাস্টমারদের সাথে সাথে এবং ভালো সমাধান দিতে পারছিলো। ইতোমধ্যেই দেশব্যাপী কোম্পানিটি নিজেদের সার্ভিস সেন্টার ছড়িয়ে দিতে কাজ করে গিয়েছে এবং বর্তমানে 80টিরও বেশি ISO certified সার্ভিস সেন্টার আছে প্রতিষ্ঠানটির। এছাড়াও এসির সার্ভিসিং এর জন্য ওয়ালটনের 3000 এরও বেশি সার্ভিস এক্সপার্ট আছে দেশজুড়ে। এ কারণে কাস্টমাররাও এখন ওয়ালটন নিয়ে এসি ব্যবহার করে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।