বাংলাদেশের লিডিং মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন মূলত নরওয়েজিয়ান রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম কোম্পানি টেলিনর এর একটি সাবসিডিয়ারিং। ২০০০ সালের দিকে কোম্পানিটি ইউরোপের youth দের টার্গেট করে ইন্টারনেট ভিত্তিক সেবাকে ফোকাস করে একটি ব্র্যান্ড লঞ্চ করে। ডিজিটাল জুস বা ডিজুস নামের এই ব্র্যান্ডটি ইউরোপের যে সব দেশে Telenor অপারেট করছিল, সেখানকার youth দের মধ্যে বেশ দ্রুতই জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। ইউরোপের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এশিয়াতেও টেলিনর ডিজুস ব্র্যান্ডটি লঞ্চ করার কথা চিন্তা করে৷ যার প্রেক্ষিতে টেলিনরের সাবসিডিয়ারিং হিসেবে বাংলাদেশে এই ব্র্যান্ডটি ইন্ট্রোডিউস করার কাজ শুরু করে গ্রামীণফোন।
ব্র্যান্ডের টার্গেট কাস্টমার গ্রুপ যেহেতু দেশের সে সময়কার ইয়াং জেনারেশন ছিল, তাই গ্রামীণফোন তাদের একটি ইয়াং টিমকে ডিজুস ব্র্যান্ড লঞ্চ করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেয়। নতুন ব্র্যান্ডের মার্কেটিং ও অ্যাডভার্টাইজিং এর জন্য স্টিম এর সাথে তখন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি বিটোপিও যুক্ত হয়। ডিজুস ও বিটোপি মিলিয়ে একটি ইনিশিয়াল প্ল্যানিং করে বেশ কিছু মার্কেটিং ও কমিউনিকেশন material ready করে। এই Material গুলো নিয়ে টিমটি ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনে ব্যবস্থা করে, যেখানে মূলত ডিজুসের টার্গেট কাস্টমার যেমন কলেজ ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট, তরুণ চাকরিজীবীরা অংশগ্রহণ করেছিল। ডিসকাশন থেকেই বুঝতে পারে তাদের ইনিশিয়াল যে আইডিয়া যে ছিল একদমই ভুল। ফোকাস গ্রুপের আচরণ, কথাবার্তা সবকিছুই প্ল্যানের থেকে একেবারেই ভিন্ন, যার প্রেক্ষিতে ডিজুস টিম আর বিটোপি একটি রিসার্চ রিপোর্ট জমা দেয় গ্রামীণফোনকে।
এই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে মার্কেটিং ও কমিউনিকেশন প্ল্যাকে ঢেলে সাজাতে শুরু করে টিমটি। টিটোপি চেয়েছিল সেই সময় দেশের youth culture কে ডিজুসের বিজ্ঞাপনগুলোর মাধ্যমে রিপ্রেজেন্ট করতে। ডিজিসের টার্গেট কাস্টমার যাদের বেশির ভাগই কলেজ ও ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী তারা ইনফর্মাল আনপলিশড স্ট্রীট ল্যাংগুয়েজে কথা বলত। অন্যদিকে দেশের টিভি কমার্শিয়াল গুলোতে ফর্মাল ভাষা ব্যবহার করা হতো। কমিশনগুলোতে কাস্টমারদের প্রোডাক্ট সম্পর্কে বিভিন্ন মেসেজ দেওয়া হতো অ্যাওয়ারনেস বাড়ানোর জন্য। কিন্তু ডিজুসের বেলায় বিটোপি একটু Different Approach নিয়েছিল।
ডিজুস লঞ্চ ক্যাম্পেইনে প্রোডাক্ট নিয়ে কথা না বলে কোনও প্রকার মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা না করে তরুণদের সাথে কানেক্ট হওয়া যায় এমন অ্যাপ্রোচ ডিজাইন করেছিল। যাতে মনে হয় ডিজুস আসলে তারুণ্যের কথাই বলছে, তারুণ্যকে সেলিব্রেট করছে। যেন ডিজুস এর সাথে সরাসরি youth দের কানেক্ট করা যায়। যে কারণে ডিজুসের বিলবোর্ড থেকে শুরু করে সকল ধরনের মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে ব্যবহার করা হয়েছিল "ফাও" "টাস্কি" ও জটিল এর মতো শব্দ, যেগুলো সে সময়ের তরুণদের মধ্যে বেশ প্রচলিত ছিল। বাংলা শব্দ লেখার জন্য ইংরেজি অক্ষর ব্যবহার করা অর্থাৎ বাংলিশে লেখা।
বিটোপি প্ল্যানটি গ্রামীণফোনকে জানালে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা নেগেটিভ কনসিকোয়েন্স নিয়ে চিন্তিত হলেও পরবর্তীতে বিটোপির প্ল্যানে পুরোপুরি সাপোর্ট দেয়। নতুন প্ল্যান অনুযায়ী ডিজুসের প্রথম টিভিসি নির্মাণের জন্য hire করা হয় জনপ্রিয় টিভি নির্মাতা ও আয়নাবাজির ডিরেক্টর অমিতাভ রেজাকে। এমনভাবে ব্র্যান্ড লঞ্চ প্রিপারেশন নেওয়া হয় যেটা বাংলাদেশে আগে কখনও কি হয়তো ভাবেওনি যে এভাবেও একটি ব্র্যান্ড লঞ্চ করা যায়। ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে লঞ্চ হয় দেশের অন্যতম আইকনিক ব্র্যান্ড ডিজুস। অমিতাভ রেজার নির্দেশনায় ডিজুসের প্রথম টেলিভিশন কৌশলটি বাংলাদেশের মার্কেটিং ও অ্যাডভার্টাইজিংয়ের ইতিহাসে অন্যতম সফল একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।
টিভিসির মূল উদ্দেশ্যই থাকে কোন প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কিংবা ব্র্যান্ডকে হাইলাইট করা। মোবাইল অপারেটরগুলো টিভিসিতে সাধারণত সিম কিংবা বিভিন্ন অফারগুলো জানানোর উপরেই জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মোস্ট আইকনিক ব্র্যান্ড Launching এ তাদের টিভিসিতে এমন কিছুই করেনি। বরং এটি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছিল, কেউ যদি প্রথমবার সেটি দেখে তাহলে দারুন একটি মিউজিক ভিডিও হিসাবে ধরে নেবে। টিভিসিটিতে বন্ধু, আড্ডা আর গান দিয়ে তরুণদের সাথে কানেক্ট করার চেষ্টা করা হয়েছিল, যা তরুণদের মধ্যে ইনস্ট্যান্ট ভালোও লেগে যায়। পুরো টিভিসিই জুড়েই প্রোডাক্ট নিয়ে সরাসরি কোনো কথা বলা তো দূরে থাক ডিজুসের লোগোটিও দেখানো হয়েছে টিভিসির একদম শেষে। ইনফ্যাক্ট টিভিসির থেকে বোঝার উপায় ছিল না যে এটা আসলে কোন প্রোডাক্ট এর বিজ্ঞাপন। ডিজুসের এই বিজ্ঞাপন দেশের ট্র্যাডিশনাল অ্যাডভার্টাইজিং ও ব্র্যান্ডিং এর মাধ্যমে কালচারাল শিফট দিয়েছিল।
বাংলাদেশে ডিজুস লঞ্চের পর প্রায় রাতারাতি কাস্টমারদের পছন্দের তালিকায় উঠে আসে। শুরুর দিকে টেলিভিশন নিউজ পেপার বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ম্যাগাজিন এবং বিলবোর্ড এর মতো প্রাইমারি মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে নিজেদের মার্কেটিং ও প্রোমোশনাল একটিভিটি চালায়। যার কারণে বেশ দ্রুতই ডিজুস দেশের ইয়াং জেনারেশনের কাছে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ডিজুস এর Unique marketing strategy এর পাশাপাশি জনপ্রিয়তার একটি মূল কারণ ছিল affordability.
সে সময় দেশের অপারেট করা সিম কোম্পানিগুলোর কলরেট ছিল প্রতি মিনিটে চার থেকে ৭ টাকা। সেখানে ডিজুসের কল রেট ছিল মাত্র দেড় টাকা। দেশের ইয়াং জেনারেশন যেখানে বেশিরভাগই স্টুডেন্ট ছিল, তাদের জন্য দেড় টাকা কল রেট বেশ অ্যাফর্ডেবল ছিল। এছাড়া ডিজুস সিমের মাধ্যমে ইউজাররা একাধিক এফএনএফ নাম্বার ও কনফারেন্স কল করতে পারতো। মাত্র পাঁচ টাকায় একশ এসএমএস কিনতে পারতেন তখন ডিজুস ইউজাররা। এত সব সুবিধা ও অ্যাফোর্ডেবিলিটি কারণে বেশ দ্রুতই ডিজুস এর সাবস্ক্রাইবারবেস বেশ বাড়তে শুরু করে।
মার্কেটিং কমিউনিকেশনের মাধ্যমে ডিজুস শুধুমাত্র দেশের ইয়াং জেনারেশনের মতো করে কথা বলত কিংবা কম খরচে কথা বলার সুযোগ করে দিত, এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারুণ্যকে উদযাপন করতে বিভিন্ন সার্ভিস ডিজুস এর হাত ধরেই আসে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল এক্সট্রা খাতি নামে কাস্টমার লয়্যালিটি প্রোগ্রাম। লয়্যালটি প্রোগ্রাম এর ইউজারদের একটি মেম্বারশিপ কার্ড দেওয়া হত যা ব্যবহার করে কিছু সিলেক্টেড ফ্যাশন স্টোর থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট, Sports Store, গানের অ্যালবাম কেনার ক্ষেত্রে ডিসকাউন্ট সুবিধা পাওয়া যেত। এতে করে তখনকার ইয়াং জেনারেশন নিজের প্রতি আরও লয়্যাল হয়ে ওঠে। এছাড়া স্টার সিনেপ্লেক্স এর সাথেও ডিজুসের একটি ডিল হয়। সেসময় স্টার সিনেপ্লেক্সে প্রতি বছর চারটি করে হলিউডের সিনেমার রিলিজ করা হত। আর ডিজুস ইউজাররা সিনেমাগুলোর টিকিট কাটার ক্ষেত্রে রিলিজ ডেট থেকে পরবর্তী ছয় দিন পর্যন্ত প্রায়োরিটি পেতেন। ডিজুস যেন কোনো টেলিকম নয় বরং হয়ে উঠেছিল তরুণদের লাইফস্টাইলেরই একটি অংশ।
যাত্রার শুরু থেকেই বাংলাদেশের গ্রামীণফোনের উন্নত টেকনোলজি এবং স্ট্র্যাটেজিক নেটওয়ার্ক expansion এর মাধ্যমে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক স্টাবলিশ করার জন্য কাজ করে এসেছে। গ্রামীণফোনের এই Overgrowing সেল টাওয়ার নেটওয়ার্ক ইনফ্রাস্ট্রাকচার কাজে লাগিয়ে ডিজুসের অপারেশন চালানো হত। ফলে অ্যাফর্ডেবিলিটি পাশাপাশি গ্রামীণফোনের স্ট্রং নেটওয়ার্ক ডিজুসের growth এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে ডিজুসের প্রতি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল রাত ১০টা থেকে সকাল ছয় টা পর্যন্ত ডিজুস টু ডিজুস কলরেট একেবারে ফ্রি করে দেওয়ার পর।
কিন্তু কেন গ্রামীণফোন এত লম্বা সময়ের জন্য প্রতিদিন কাস্টমারদের একেবারে ফ্রিতে কথা বলার সুযোগ করে দিল?
গ্রামীণফোনের কর্মকর্তারা খেয়াল করে দেখল যে, রাত দশটার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির নেটওয়ার্ক এর তেমন কোনও অ্যাক্টিভিটি নেই বললেই চলে। কিন্তু সে সময় তো আর সেল টাওয়ার অফ করে রাখা যাবে না। তাই এই আনইউজড নেটওয়ার্ককে কাজে লাগাতে প্রতিষ্ঠানটি এই অফার শুরু করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির এই অফারের পিছনে আদতে আরও বড় একটি কারণ লুকিয়ে ছিল। অনেকটাই জাপানের মার্কেটে কফি খাওয়া শেখানোর জন্য নেসক্যাফ এর নেওয়া initiative এর মতোই। যাঁরা জানেন না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নেসক্যাফে জাপানে প্রচুর পরিমাণে অ্যাডভার্টাইজিং ও প্রমোশনাল অ্যাক্টিভিটি চালানো সত্ত্বেও জাপানের জনগণকে কফিতে অভ্যস্ত করাতে পারছিল না। তাই কোম্পানিটি একজন সাইকো অ্যানালিস্টের পরামর্শে জাপানের বাচ্চাদের জন্য কফি ফ্লেভারের চকলেট ইন্ট্রোডিউস করে সেটা প্রমোশন চালাতে শুরু করে। চা পান করা জাপানিদের সাথে কফির সাথে ছোটবেলা থেকে কোনও অ্যাসোসিয়েশন ছিল না বিধায় নেসক্যাফে মার্কেটিং ও প্রোমোশনের এত খরচ করে কফি জনপ্রিয় করতে পারেনি। আর তাই ছোট থেকেই বাচ্চারা যেন কফির সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং বড় হয়ে নেসক্যাফের কাস্টমার হয়ে ওঠে। তাই নেসক্যাফে এই স্ট্র্যাটেজি নেয়।
বাংলাদেশের তৎকালীন সময়ে মোবাইল ফোনে কলরেট এত বেশি ছিল যে মানুষ প্রয়োজন ছাড়া ফোনে কথাই বলত না। কিন্তু একটি মোবাইল কোম্পানির গ্রোথ এর জন্য মানুষ যেন প্রয়োজন ছাড়া ফোনে কথা বলতে অভ্যস্ত হয় সেটা এস্টাব্লিশ করার প্রয়োজন ছিল। যার জন্য ডিজুস ইউজাররাই ছিল পারফেক্ট টার্গেট গ্রুপ। ডিজুসের টার্গেট কাস্টমারই ছিল বয়সে তরুণ, যারা রাস্তায় কিংবা টঙের দোকানে আড্ডা দিত। তখনও দেশের সবার কাছে ইন্টারনেটে অ্যাক্সেসিবিলিটি না থাকায় সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচলন ছিল একেবারেই কম। যার কারণে আড্ডাটা ছিল লিমিটেড৷ রাত বাড়লেই আড্ডা থেকে ফিরতে হত বাসায়। তরুণদের এই আড্ডাকে আনলিমিটেড করার জন্যই মূলত ডিজুস এই অফার নিয়ে আসে। কনফারেন্স কল এর সুবিধা উপভোগ করে তরুণরা ঘরে বসেই কোনো খরচ ছাড়াই আড্ডা দিতে পারছিল, বিধায় ইন্সট্যান্টলি ডিজুস জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যায়। আর এভাবেই ফোন কলে আড্ডা দিতে দিতে মানুষের লম্বা সময় ফোনে কথা বলাতে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং টেলকম কোম্পানির জন্য আরও রেভিনিউ নিয়ে আসে।
এছাড়াও ডিজুস তরুণদের অফলাইনের আড্ডাকে ডিজিটাল আড্ডা রূপান্তর করেছে। সে হিসেবে কিন্তু ডিজুসকে দেশের প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া বলাই যায়। এ ছাড়া অপরিচিত নম্বরে ফোনে কথা বলা, বন্ধুত্ব কিংবা প্রেমের সম্পর্ক ভাঙা-গড়ার করার মতো হাজার হাজার ঘটনার রূপকার ছিল ডিজুস। সে সময়ে এই ব্যাপারগুলো এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল যে, তৎকালীন সময়ে নাটক সিনেমাতেও এ ধরনের ঘটনা উঠে এসেছিল। নাটক সিনেমা তো আল্টিমেটলি একটি সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। এছাড়া ডিজুস স্পনসরশিপে তখন দেশ জুড়ে নানা কনসার্ট আয়োজন করা হতো।
বর্তমান সময়েও কনসার্ট কিংবা মিউজিক ফেস্ট হলেও ২০০৫ থেকে ২০১১-১২ তে বেড়ে ওঠা তরুণ জেনারেশন কনসার্টে আমেজ বা উদ্দীপনা পেয়েছে, তার কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। বিভিন্ন কনসার্ট আয়োজন করা ছাড়াও ডিজুস দেশের প্রথম ব্যান্ড মিউজিক সহ ডি-রকস্টার আয়োজন করেছিল। যেখান থেকে বর্তমান রেডিও অ্যাক্টিভ ও পার্সার মত জনপ্রিয় ব্যান্ড গুলো উঠে আসে। নয় সে। এমনকি দেশের লিডিং রেকর্ড লেভেল জিসিরিজের সাথে পার্টনারশিপে ডিজুস দেশের আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যান্ড গুলোকেও প্রোমোট করছিল৷ শুধু যে ব্যান্ড সঙ্গীত কিংবা পাশ্চাত্য সেন্টার কালচার কে ডিজুস প্রোমোশনাল স্ট্র্যাটেজিতে অ্যাড করেছে তাই নয়। দেশের তরুণরা যেখানে ডিজুসও সেখানে অংশগ্রহণের চেষ্টা করছে। যেমন একবার পহেলা বৈশাখে ডিজুস চারুকলা থেকে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় স্পনসর হতে চেষ্টা করেছিল। যদিও তাঁদেরকে মানা করে দেওয়া হয়। তবে এতে ডিজুস টিম থেমে না থেকে ঢাকা ভার্সিটির টিএসসি এলাকা থেকে শুরু করে শাহবাগ ও রমনা এলাকার বিভিন্ন স্থানে ডিজুস এর লোগো সহ ফ্রি ফতোয়া ও ব্যানার বেলাতে শুরু করে। এতে খুব বেশি টাকা খরচ না করেও ব্যাপক আকারে ব্রান্ডিং হয়। সার্ভিসটি রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে অলিতে গলিতে, এমনকী পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের পাতায়, বিলবোর্ড আর দেয়ালে দেয়ালে ডিজুসে ভরে ওঠে৷
ডিজুসের জনপ্রিয়তা তখন এতটাই তুঙ্গে উঠে যায় যে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বেড়ে ওঠা এই জেনারেশনকে এখন অনেকে ডিজুস ডিজেনারেশন ডাকে।
বর্তমানে ডিজুস জেনারেশন কথাটা অনেকের জন্য নস্টালজিয়া হলেও একটা সময় উচ্ছন্নে যাওয়া তরুণদের বোঝাতে এই শব্দটা ব্যবহার করা হত। ইনফ্যাক্ট ডিজুস লঞ্চ হওয়ার পরপরই ডিজিটাল ব্র্যান্ড কমিউনিকেশনের জন্য জিও তথাকথিত রাস্তার ভাষা ব্যবহারের কারণে অভিভাবকদের কাছ থেকে বেশ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এমনকি ইয়াং জেনারেশন এবং ডিজুসকে নিয়ে সে সময় দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরণের সমালোচনামূলক লেখা ছাপা হয়েছিল বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে।
কিন্তু এত সমালোচনার পরও প্যারেন্ট কোম্পানি হিসেবে গ্রামীণফোন সবসময় ডিজিটাল মার্কেটিং এক্টিভিটি সাপোর্ট করে গিয়েছে। এদিকে অ্যাফোর্ডেবিলিটি থেকে শুরু করে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধার কারণে তরুণদের পাশাপাশি অন্যান্য বয়স ও শ্রেণি পেশার মানুষরাও ডিজুসে বিশ্বাস করতে শুরু করে। ইনফ্যাক্ট বিষয়টা এমন দাঁড়িয়ে যায় গ্রামীণফোনের কাস্টমাররাও ডিজুসে শিফট করতে শুরু করে। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় ডিজুসের জন্য।
ডিজুস যত দ্রুত বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, ঠিক সেভাবেই আবার হারিয়েও গিয়েছে। ডিজুসের শেষ ক্যাম্পেইন ছিল ২০১২ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কে দেওয়া একটি ট্রিবিউট। কিন্তু তার বেশ আগে থেকেই জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছিল। যার প্রেক্ষিতে কোনো ধরণের পূর্বাভাস ছাড়াই ডিজুস সিম বিক্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ডিজুসের সকল ধরনের মার্কেটিং ও প্রোমোশনাল অ্যাক্টিভিটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কেন গ্রামীণফোন তাদের অন্যতম সফল এই ব্র্যান্ডটি প্রতি এতটা উদাসীন হয়ে পড়ে?
ডিজুস কেন বন্ধ হলো, এই বিষয়ে গ্রামীণফোন কখনও সরাসরি কোনও বিজ্ঞপ্তি না দিলেও পত্রপত্রিকায় ডিজুস বন্ধ হওয়ার পেছনে Sustainability কে মূল কারণ হিসেবে জানিয়েছিল। কিন্তু Sustainability ইস্যু গুলো আসলে কী তা কখনোই এক্সপ্লেন করেনি প্রতিষ্ঠানটি। তবে ধারণা করা যায়, যেহেতু গ্রামীনফোনের রিসোর্স ব্যবহার করতো, তাই ফ্রি কল রেট পেয়ে গ্রামীনফোনের নেটওয়ার্ক অ্যাকটিভিটিও হুট করে অনেক বেড়ে যায়। এতে করে প্রায় সময় গ্রামীণফোনের কাস্টমাররা তাঁদের প্রয়োজনে কল কানেক্ট করতে পারত না। এমন পরিস্থিতিতে যদি সেই অফারটি রাত 10:00 টার বিপরীতে রাত 12:00 থেকে ছয় টা করা হয়েছিল, তবু কল কানেক্ট করতে না পারা এবং কল ড্রপের মতো ইস্যুগুলি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়।
এছাড়া সাব ব্র্যান্ড ডিজুসের কল রেট কম হওয়াতে গ্রামীণফোনের কাস্টমারও গ্রামীণফোনের সিম ব্যবহার বন্ধ করে ডিজুসের সিম ব্যবহার করতে শুরু করে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ডিজুসের কাছে গ্রামীণফোন মার্কেট হারাতে শুরু করে। এছাড়া ডিজুসের কল রেট কম হওয়াতে গ্রামীণফোনের average revenue অনেকাংশে কমে আসে। যা গ্রামীণফোনের সিস্টেমের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে।
ইউজার বাড়তে থাকায় এক সময় ফ্রি কল রেট পুরোপুরি বাদ দেওয়া হলে অনেকের কাছেই ডিজুস জনপ্রিয়তা হারায়। ২০০৫ সালে লঞ্চের সময় ডিজুস দেশের ইউথ কে টার্গেট করে কার্যক্রম শুরু করে, যারা পরবর্তী দশকে পড়াশোনা শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করে৷ অর্থাৎ ডিজুসের কাস্টমার বেস আরও ম্যাচিওর হতে শুরু করে। অন্যদিকে নতুন জেনারেশনেকে টার্গেট করে বাংলালিংক, এয়ারটেল রবি ও অ্যাফর্ডেবল প্যাকেজ নিয়ে আসতে শুরু করে। বিশেষ করে এয়ারটেল একই বিষয়কে লক্ষ্য করে নিজেদের সার্ভিস সাজিয়েছিল এবং ডিজুসের মতো বন্ধুত্বকে ফোকাস করেই একই ধরনের সিস্টেম করে নিজেদের ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন চালিয়েছিল৷ এই ধরনের কম্পিটিটিভ মার্কেটে ডিজুসের মতো কম লাভজনক আলাদা একটি ব্র্যান্ড পরিচালনা করে যাওয়াটা গ্রামীণফোনের জন্য তেমন ফলপ্রসূ হত না।
এছাড়া ২০১০ সালের পর থেকে ইন্টারনেটের availability বাড়তে থাকে। ২০১২ সালে বাংলাদেশ ৩জি ইন্টারনেটের যুগে প্রবেশ করে। যার কারণে ডিজুসের ডিজিটাল আড্ডাগুলো ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ও মেসেজিং অ্যাপে শিফট হতে শুরু করে। ২০১৩ সাল নাগাত তো মেসেঞ্জারে ফ্রি কল ফিচারও চলে আসে। বিশ্বে ইন্টারনেটের এ ধরণের availability এর বিষয়টিকে আমলে নিয়েই হয়তো গ্রামীণফোন চিন্তা করেছিল ডিসকন্টিনিউ করে যাওয়াটা হয়তো ঠিক হবে না। আর এভাবে এক সময় বন্ধ হয়ে যায় দেশের অন্যতম আইকনিক ব্র্যান্ড ডিজুস। বর্তমানে ডিজুস কেবলমাত্র একটি প্যাকেজ আকারে অ্যাভেলেবেল আছে।